কেউ পেটায় লাঠি দিয়ে, কেউ মোটা তারে
চুরির অপবাদ দিয়ে তিন কিশোরকে মারধরের সময় অংশ নেন অন্তত ৪০ জন।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চুরির অপবাদ দিয়ে কিশোর হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে তাঁরা উল্লেখ করেন, লাঠিসোঁটা, বিদ্যুতের মোটা তার ও কিলঘুষিতে কিশোরের মৃত্যু হয়। এতে অংশ নেন অন্তত ৪০ জন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া লোকজন সরে যান।
ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, গত শনিবার বিকেলে চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোতাসিম বিল্লাহর আদালতে জবানবন্দি দেন দুই আসামি। তাঁরা হলেন আজাদ হোসেন (৩৬) ও মোহাম্মদ নোমান (৩৭)। এর মধ্যে নোমান পল্লিচিকিৎসক ও আজাদ গাড়িচালক। ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।
গত শুক্রবার ভোরে চট্টগ্রাম নগর থেকে বাড়ি ফিরছিল ওই তিন কিশোর। তাদের বাড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। বাড়ির কাছাকাছি এলে তাদের চোর অপবাদ দিয়ে সেতুতে বেঁধে পেটান বিভিন্ন ব্যক্তি। এতে ঘটনাস্থলে মো. রিহান মাহিন (১৫) নামের এক কিশোর মারা যায়। একই ঘটনায় রিহানের দুই বন্ধু মুহাম্মদ মানিক ও মুহাম্মদ রাহাত গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে। রাহাত চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে আর মানিক ক্যাজুয়ালটিতে চিকিৎসাধীন। দুজনেরই শরীরের একাধিক হাড় ভেঙেছে।
এ ঘটনায় নিহত কিশোরের মা খদিজা বেগম বাদী হয়ে ফটিকছড়ি থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও সাতজনকে আসামি করা হয়। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আজাদ ও নোমানকে গ্রেপ্তার করে।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে আসামি আজাদ হোসেন বলেন, ছয় দিন আগে এলাকায় কিছু কবুতর চুরি হয়। সেই চুরির অপবাদ দিয়ে ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে আসা মাহিনসহ তিনজনকে ধরার চেষ্টা করেন। ওই সময় আজাদ, ফাহাদ, ইমন, আনোয়ার, মুন্না, শাওনসহ ছয়জন ছিলেন। তিন কিশোরকে ধাওয়া দিলে তারা পাশের একটি বাড়ির ছাদে উঠে যায়। পরে তাদের ধরে এনে এলাকার একটি সেতুর সঙ্গে বাঁধা হয়। খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ছুটে আসেন নিহত মাহিনের মা-বাবা।
স্থানীয় বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন, সুমন, তানভীরসহ অন্তত ৪০ জন তিন কিশোরকে মারধর করতে থাকেন। কারও হাতে লাঠিসোঁটা আর কারও হাতে বিদ্যুতের তার। আর কেউ কিলঘুষি মারেন। মারধরের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মাহিন। তার মুখে পানি ছিটানো হয়। নিশ্বাস আছে কি না, নাকে হাত দিয়ে দেখা হয়। পরে সেখানে থাকা পল্লিচিকিৎসক নোমান নিশ্চিত করেন মাহিন মারা গেছে। এরপর যে যার মতো সরে যায়।
আরেক আসামি মোহাম্মদ নোমানও তাঁর জবানবন্দিতে এলাকায় চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিশোর মাহিনসহ তিনজনকে মারধরের কথা স্বীকার করেন। তিনি নিজে মাহিনের শরীর যাচাই করে মৃত্যুর বিষয়টি উপস্থিত সবাইকে নিশ্চিত করেন। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া অন্য আসামিদের নামও বলেন।
দুই আসামির জবানবন্দিতে এলাকায় চুরির অপবাদ দিয়ে তিন কিশোরকে ধরে মারধরের কথা স্বীকার করলেও ফটিকছড়ি থানার ওসি নুর আহমদ প্রথম আলোকে, ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে ওই এলাকায় কোনো চুরির ঘটনা ঘটেনি। তাঁরা নিজেরা বাঁচার জন্য চুরির কথা বলছেন। পূর্বের কোনো বিরোধ থেকে নাটক সাজিয়ে ওই কিশোরদের পেটানো হয়েছে।
মামলার বাদী ও নিহত মাহিনের মা খদিজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেকে বেঁধে মারধর করা হচ্ছে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম। আমার ছেলে চোর নয়, বারবার বলার পরও আমার সামনে ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। একটু পানি চাইছিল, তারা পানি পর্যন্ত দিতে দেয় নাই।’
উৎসঃ https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/nwk07wx827
0 Comments