Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বাবার কোলে ভর করে নাইছের যুদ্ধ

 


বাবার কোলে ভর করে নাইছের যুদ্ধ


বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের বিজ্ঞান ভবন। দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে বসে আছেন এক তরুণী। বাঁ হাতে কলম ধরা, চোখে একাগ্রতা, কপালে ঘাম। চার ঘণ্টার পরীক্ষা।
প্রতিটি লাইন লিখতে যেন পুরো শরীরের শক্তি ঢেলে দিচ্ছেন। বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর বাবা নজরুল ইসলাম, যিনি কয়েক মিনিট আগে মেয়েকে কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এনেছেন। চারপাশে শত শত শিক্ষার্থী হাঁটছে নিজ নিজ ভরসায়। অথচ নাইছ খাতুন এখনো ভরসা করেন বাবার দুই হাতকে।নাইছের বয়স ২৪ বছর। জন্ম থেকে দুটি পা অচল, ডান হাতেও শক্তি নেই। একমাত্র বাঁ হাতই তাঁর ভরসা। আর সেই ভরসাকে সঙ্গী করেই তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনের।
বগুড়ার ধুনট সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।


ছোটবেলা

বগুড়ার ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ী ইউনিয়নের বিশ্বহরিগাছা গ্রামে জন্ম। বাবা দিনমজুর, মা গৃহিণী। সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। এত অনটনের মধ্যেও মেয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে মা-বাবা কখনো আপস করেননি।

পড়ার খরচ জোগাতে প্রতিবেশীর কাছে হাত পাততে হয়েছে সময়ে-অসময়ে। ছোটবেলা থেকেই নাইছের পড়াশোনার প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ। বই পেলে এক হাত দিয়ে ধরে নাড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন।

স্কুলজীবন

বাবার সাহায্য ছাড়া এক কদম সামনে যাওয়ার উপায় নেই নাইছের। ছয় বছর বয়সে তাঁকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর প্রতিটি ধাপ বাবার কোলে ভর করে পার করেছেন নাইছ। বিশ্বহরিগাছা-বহালগাছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০১৯ সালে বিশ্বহরিগাছা-বহালগাছা বহুমুখী মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। বর্তমানে ধুনট সরকারি ডিগ্রি কলেজে অনার্স পড়ছেন। পড়ালেখা ভালো করার জন্য তাঁকে প্রতিটি মুহূর্তে করতে হয়েছে সীমাহীন লড়াই।

প্রতিদিনের সংগ্রাম

বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। কখনো বাবার কাঁধে চড়ে পুরো পথ পাড়ি দিয়েছেন, কখনো বা সাইকেলের পেছনে করে। আর অনার্স পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে হলে প্রায় ৩০০ মিটার কাঁচা রাস্তা পেরোতে হয়। সেই পথ বাবার কোলে চড়েই অতিক্রম করতে হয় নাইছকে। তারপর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে পৌঁছেন শহরে। আবার দ্বিতীয় তলায় পরীক্ষার হলে পৌঁছে দেন বাবা।

নাইছের কণ্ঠে কষ্ট

বন্ধুরা হেঁটে স্কুল-কলেজে যায়, নিজেরা যা খুশি করতে পারে। অথচ চাইলে এক গ্লাস পানিও এনে খেতে পারি না। তখন মনে হয় আমি অনেক বোঝা। বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে নাইছের। আবার দৃঢ়চেতা কণ্ঠে বলেন, কিন্তু আমি হার মানতে চাই না। বাবা যেভাবে আমাকে কষ্ট করে কোলে নিয়ে স্কুল-কলেজে পৌঁছে দিয়েছেন, আমি চাই একদিন এমন কিছু করতে, যাতে তিনি গর্ব করে বলতে পারেনএটাই আমার মেয়ে।

জন্মই যেন আজন্ম পাপ

কাছের মানুষদের নাক সিটকানো তো ছিলই। তারা বলত, প্রতিবন্ধী মেয়ে নিয়ে আহ্লাদ। পড়াশোনা করলে মনে হয় জজ, ব্যারিস্টার হবে। মানুষের বাজে কথা নাইছের অগ্রযাত্রায় কখনো বাধা হয়নি। জন্ম থেকেই নাইছের দুই পা, ডান হাতে সমস্যা। ডাক্তার, কবিরাজ দেখানো কিছুই বাদ রাখেননি নাইছের বাবা। আজ পিজি, তো কাল পঙ্গু হাসপাতাল। এভাবে কেটে যায় ছয় বছর। উন্নতি বলতে, এখন নাইছ হামাগুড়ি দিতে পারেন। বসিয়ে দিলে এক হাত দিয়ে কাজ করতে পারেন। সুস্থ মানুষের মতো অবিকল তাঁর হাত-পা। বাইরে থেকে অসুস্থ বোঝার কোনোই উপায় নেই। চিকিৎসকরা বলেছেন, জন্মের সময় কোনোভাবে নাইছ আঘাত পেয়েছেন। তবে নাইছের মা জানান, যত রকমের চিকিৎসা করতে চিকিৎসকরা বলেছিলেন, টাকার অভাবে তা সব করা সম্ভব হয়নি। এখানো মাঝেমধ্যে নাইছ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর মুখে ঘা হয়। ত্বকে টুকটাক সমস্যা লেগেই থাকে। প্রায়ই চিকিৎসক দেখাতে হয়।

বাবার চোখে মেয়ে

নজরুল ইসলাম বলেন, মেয়ে পড়াশোনায় খুব আগ্রহী। সে হার মানেনি কখনো। আল্লাহ যদি আমাকে শক্তি দেন, শেষ ডিগ্রিটুকু সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মেয়েকে বয়ে নিয়ে যাব।  নাইছের মা আকতার জাহান গৃহিণী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাইছ ছোট। জন্ম থেকেই নাইছের ছিল হাসিভরা মুখ। কিন্তু মুখ ভর্তি হাসির আড়ালে রাজ্যের দুঃখ-কষ্ট থাকলেও তা কাউকেই বুঝতে দেন না নাইছ।

প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আলো

নাইছ শুধু পড়াশোনা করেই নয়, নিজের অদম্য মনোবল দিয়েও অন্যদের অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, মনোবল অটুট রেখে আমি এগিয়ে গিয়েছি। শরীরে জোর নেই, টানা লিখতে গেলে হাত ব্যথা হয়, তবু আমি লড়ে যাচ্ছি। কত মানুষ কত কথা বলেছে, চুপ করে শুনেছি। তাদের বাজে কথার জবাব হয়ে উঠেছে পড়াশোনায় আমার সাফল্য। সম্প্রতি

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন নাইছ। বাড়িতে সপ্তাহে পাঁচ দিন, প্রায় ৩০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে দুই ঘণ্টা পড়াতে হয় তাঁকে। বিনিময়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা পান।

দরকার একটি কম্পিউটার

এরই মধ্যে কম্পিউটারের বেসিক কাজগুলো শিখে নিয়েছেন। তবে নিজের কম্পিউটার নেই বলে অনেক কিছু করতে পারছেন না। নাইছ বললেন, একটি কম্পিউটার হলে ভালো হতো। ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন নাইছ। তিনি বলেন, যারা আমার মতো কষ্টে আছে, তারা যেন শিক্ষা থেকে দূরে না সরে যায়। আমি যদি শিক্ষক হতে পারি, তাহলে তাদের দেখাতে পারব শিক্ষা হলো একমাত্র শক্তি, যা কাউকে প্রতিবন্ধী মনে করে না।

সূত্র : কালবেলা

Post a Comment

0 Comments