পাগলা মসজিদ কীভাবে হলো, কারা দেন এত টাকা- কী হয় তা দিয়ে
ডেস্ক প্রতিবেদন: তাহাদনিউজ২৪/৬সেপ্টেম্বর২০২৫
কমপ্লেক্সটি নির্মিত হলে একসঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। সেই সাথে ৫ হাজার নারীর নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থাসহ মুসুল্লিদের ২০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে
কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। সকল ধর্মের মানুষের কাছেই এক সর্বজনীন পবিত্র ধর্মীয় স্থানে পরিণত হয়েছে পাগলা মসজিদ। এই মসজিদের ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে পরিচিত। তবে দেশজুড়ে এর পরিচিতি অন্য কারণে।
পাগলা মসজিদ নাম শুনলেই বর্তমানে যেটি মাথায় আসে সেটি হলো মসজিদের দানবাক্স খুলেলই মেলে কোটি কোটি টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার। এ মসজিদকে ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। দেশের মানুষের মাঝেও রয়েছে নানা কৌতুহল। কারা দেন এসব টাকা, কেন এই কোটি টাকার দান; কী হয় এই দানের টাকায়?
পাগলা মসজিদের ইতিহাস
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হয়বত নগর এলাকার প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান হয়বত খানের অধীনস্থ তৃতীয় পুরুষ জুলকরণ খানের বিবি সাহেবা মূলত একদিন স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে দেওয়ানবাড়ির অদূরে নরসুন্দা নদীর তীরে এই পাগলা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই তথ্য হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ির নথিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে। প্রতিষ্ঠাকালে মসজিদের ভূমির পরিমাণ ১০ শতাংশ থাকলেও, এখন তা সম্প্রসারিত হয়ে প্রায় ৫ একরে দাঁড়িয়েছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, প্রায় আড়াইশ বছর আগে এক আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর পানিতে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে থেমে ছিলেন। তখন নদীর পানিতে মাদুর পেতে তার ভেসে আসা দেখে, তাকে ঘিরে আশপাশের অনেক ভক্তকূল সমবেত হন। এরপর সেই পাগলবেশী আধ্যাত্মিক পুরুষ এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ বিভিন্ন ইবাদত করতেন। ওই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে এই মসজিদটি গড়ে উঠে। যা কালক্রমে ‘পাগলা মসজিদ’নামে পরিচিত।
এ মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও নামাজ আদায়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। নারীরা মসজিদের পৃথক স্থানে নামাজ আদায় করেন। সকল ধর্মের মানুষ প্রতিনিয়ত মানতের নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, বৈদেশিক মুদ্রা, গরু-ছাগল, হাস-মুরগীসহ মানতের বিভিন্ন সামগ্রী দান করে থাকেন। তাই প্রতিমাসে শুধু দানের নগদ অর্থ আর বিভিন্ন দানসামগ্রী থেকেই এ মসজিদের আয় হয় কোটি টাকারও বেশি।
প্রতি তিন মাস পর পর খোলা হয় এই মসজিদের লোহার দানসিন্ধুক। মসজিদের দানসিন্ধুকগুলো খুলতেই দেখা যায় শুধু টাকা আর টাকা। এসব টাকা বস্তায় ভরে নেয়া হয় ঐ মসজিদের দোতলায়। পরে মসজিদের মেঝেতে বসে দিনব্যাপী টাকা গুনেন মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ ব্যাংক কর্মকর্তারা।
গণনা শেষে মসজিদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা জমা রাখতে সম্পূর্ণ পুলিশি নিরাপত্তায় দানের সব টাকা নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাংকে। পাগলা মসজিদের টাকায় মসজিদের পাশেই একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে এই মাদ্রাসায় এতিম শিশুরা পড়াশোনা করে। মসজিদের টাকায় তাদের যাবতীয় ভরণপোষণ করা হয়ে থাকে।
মসজিদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা রাখা দানের টাকা থেকে আশা লভ্যাংশ ব্যয় করা হয়, দুস্থ ও দূরারোগ্য রোগীদের মাঝে। এছাড়া মসজিদের মূল তহবিলের টাকা এখন আর কোথাও ব্যয় করা হচ্ছে না বলেই জানিয়েছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। কারণ মসজিদের দানের টাকায় আন্তর্জাতিক মানের একটি দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। যেটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে নির্মিত হবে। আন্তর্জাতিক মানের এ কমপ্লেক্সটি নির্মিত হলে একসঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। সেই সাথে ৫ হাজার নারীর নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থাসহ মুসুল্লিদের ২০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
প্রতি অর্থবছর ওয়াকফ স্টেটের অডিটর দ্বারা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়। সবশেষ মসজিদের দানসিন্ধুক খুলে রের্কড পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়। যা অন্যান্যবারের সকল রের্কড ভেঙ্গে তৈরি করেছে নতুন রের্কড। সর্বশেষ এ বছরের ৩০ আগস্ট গণনা শেষে ১২ কোটি ৯ লক্ষ ৩৭ হাজার ২২০ টাকা পাওয়া যায়। যা ৪ মাস ১৭ দিনে মসজিদের ১৩টি দানসিন্ধুকে জমা পড়েছিলো। যা অতীতের সব রের্কড ছাড়িয়েছে।
দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত মসজিদটিকে ২০১৬ সালে পাগলা মসজিদ ইসলামি কমপ্লেক্সে নামকরণ করা হয়। মসজিদটি পরিচালনার জন্য ওয়াকফ প্রশাসন অনুমোদনকৃত একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে জেলা প্রশাসক সভাপতি এবং কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সদস্য সচিব। এছাড়াও মসজিদের খতিবসহ স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা এই কমিটিতে মসজিদ পরিচালনার কাজে দায়িত্ব পালন করছেন।
এত টাকা কারা দেন
এত দান পাবার কারণ সকল ধর্মের মানুষের কাছে পাগলা মসজিদ এক সর্বজনীন পবিত্র স্থান। মানুষের বিশ্বাস, কেউ যদি খালেস নিয়তে পাগলা মসজিদে কোনো কিছু দান করে তাহলে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এ ধরনের বিশ্বাস থেকে প্রতিনিয়ত দানের পরিমাণ বেড়েই চলছে। রোগমুক্তি, উচ্চ শিক্ষা, সন্তান লাভ, বিয়ে, সুখী সংসার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে এই মসজিদে মানত করে থাকেন। শুধু টাকা,পয়সা নয়, স্বর্ণালঙকার, হাস-মুরগী, গবাদিপশুসহ বিভিন্ন পণ্য দান করে থাকে মানুষ।
তবে এ মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মুসল্লিদের খুবই কষ্ট করতে হয়। কারণ স্থান সংকুলান না হওয়ায় রাস্তায় নামাজ আদায় করতে হয় মুসল্লিদের। মুসল্লিদের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হোক।
অভিযোগ ও সুপারিশ
মসাজিদে মানতের বিভিন্ন দানসামগ্রী প্রতিদিন আসরের নামাজের পর প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ পরদিন ব্যাংক আওয়ারে মসজিদের হিসাব নম্বরে জমা রাখা হয়। যা পরে প্রতিমাসে ব্যয় করা হয় কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও মসজিদের বিভিন্ন রক্ষণাবেক্ষণের কাজে। কিন্তু এ নিলামকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে; যে কারণে নিলামে ডাকা দানসামগ্রীগুলোর প্রকৃতমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে শক্তিশালী একটি সাব-কমিটি (নিলাম কমিটি) করা জরুরি বলে জানিয়েছেন মুসল্লিরা।
ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, পাগলা মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে তুরস্কের স্থাপত্যশৈলীতে আধুনিক ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মিত হবে। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স পরিচালনা কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
অনলাইনেও দান করা যাবে পাগলা মসজিদে
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্সের ওয়েবসাইট এবং অনলাইন ডোনেশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। www.paglamosque.org নামে ওয়েবসাইটটির উদ্বোধন করেন পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্সের সভাপতি কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান। এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসে মানুষ মসজিদটিতে তাদের দানের টাকা পাঠাতে পারবেন। এছাড়া ওয়েবসাইটটির মাধ্যমে পাগলা মসজিদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নামাজের সময়সহ বিভিন্ন তথ্য জানা যাবে।
0 Comments